গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলা
গোপালগঞ্জ, ১৬ জুলাই ২০২৫:
গোপালগঞ্জ জেলা শহরে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পূর্বঘোষিত সমাবেশে সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটেছে। এনসিপির অভিযোগ, এ হামলায় জড়িত ছিল আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একাংশের নেতাকর্মীরা, যাদের অনেকেই সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতার অভিযোগে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
পরিকল্পিত হামলার অভিযোগ
ঘটনাটি ঘটে মঙ্গলবার বেলা আড়াইটার দিকে, শহরের জমজমাট কলেজ মোড় এলাকায়। এনসিপির উদ্যোগে আয়োজিত ছিল ‘গণতন্ত্র ও জাতীয় ঐক্য’ শীর্ষক জনসভা। বক্তৃতা শুরুর কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ করে ৫০-৬০ জনের একটি দল হাতে লাঠি, বাঁশ ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসে এবং হট্টগোল শুরু করে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও এনসিপির নেতারা জানিয়েছেন, হামলাকারীরা সমাবেশ মঞ্চ ভাঙচুর করে, চেয়ার-টেবিল ছুঁড়ে ফেলে এবং ব্যানার-পোস্টার ছিঁড়ে ফেলে। এতে অন্তত ১৫ জন এনসিপি কর্মী আহত হন, যাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানা গেছে। আহতদের গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতাল ও একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে।
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
স্থানীয়রা জানান, হামলার সময় পুলিশের একটি টহল দল কাছেই অবস্থান করলেও তারা তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ করেনি। এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব শামসুল হক অভিযোগ করে বলেন, “পুলিশ নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। এটি প্রশাসনিক মদদের ফল বলেই আমাদের আশঙ্কা।”
হামলাকারীদের পরিচয়
এনসিপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, হামলায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অনেকেই ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের পূর্বে নিষিদ্ধ ঘোষিত উপদলভুক্ত নেতাকর্মী। এদের মধ্যে কয়েকজনের নাম প্রকাশ করেও দলটি জানায়, তারা ইতিপূর্বে রাজনৈতিক সহিংসতা, চাঁদাবাজি ও অস্ত্র ব্যবহারের কারণে জেলা প্রশাসন ও দলের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন।
তবে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন হামলায় দলের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “এটি এনসিপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফল হতে পারে। আমরা কোনও ধরণের সহিংস রাজনীতি সমর্থন করি না।”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান
গোপালগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশরাফুল ইসলাম বলেন, “ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও পরবর্তী কর্মসূচি
এই ঘটনার পর এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে তীব্র নিন্দা জানান এবং সরকারের বিরুদ্ধে ‘গণতান্ত্রিক অধিকার হরণে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’ করার অভিযোগ তোলেন। দলের চেয়ারম্যান মাহবুব হোসেন বলেন, “এই হামলা শুধুই একটি দলের ওপর নয়, এটি দেশের গণতন্ত্রের ওপর সরাসরি আঘাত।”
তিনি আরও ঘোষণা করেন, “আগামী এক সপ্তাহ দেশব্যাপী জেলা ও মহানগরে বিক্ষোভ, মানববন্ধন এবং কালো ব্যাজ ধারণ কর্মসূচি পালন করা হবে।”
নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনের উদ্বেগ
এ ঘটনায় বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজ তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মানবাধিকার সংগঠন ‘নাগরিক অধিকার পরিষদ’ এক বিবৃতিতে বলেছে, “একটি রাজনৈতিক দলের সভায় হামলা গণতন্ত্রবিরোধী ও ফ্যাসিবাদী প্রবণতার প্রকাশ। দেশের সংবিধান সকল দলের সভা-সমাবেশের অধিকার স্বীকৃতি দিয়েছে।”
উপসংহার
গোপালগঞ্জের এই ঘটনা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক অস্বস্তিকর বার্তা দেয়। যেখানে বিরোধী মত প্রকাশের অধিকার রক্ষা করা উচিত, সেখানে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলার ঘটনা দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।














