সংবিধান, বিচার বিভাগসহ ছয়টি ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলো প্রতিনিধিত্বশীল হয়নি। কোনোটিতেই ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। নারীর সংখ্যাও কম।
পূর্ণাঙ্গভাবে ঘোষিত ছয়টি কমিশনের মোট সদস্য ৫০ জন। এর মধ্যে সাবেক আমলা ১৫, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ২, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ৮, বিচারপতি ও বিচারক ৫, আইনজীবী ৬, শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ৬ এবং অন্যান্য পেশার (এনজিও, মানবাধিকারকর্মী, বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি) ৮ জন। এসব পেশাজীবীর মধ্যে নারী পাঁচজন। শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ছয়জনের মধ্যে শুধু একজনের নাম জানানো হয়েছে।
এর বাইরে চারটি কমিশনের শুধু প্রধানদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ১০টি কমিশনের প্রধান পদে নারী স্থান পেয়েছেন মাত্র একজন। তা–ও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনে।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, সংস্কার কমিশনগুলোতে আমলাদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় রাখা হয়েছে। তবে সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষকদের প্রাধান্য বেশি (পাঁচজন)।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থী ও অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের কথা বলা হচ্ছে; কিন্তু সংস্কার কমিশনগুলো গঠনের ক্ষেত্রে তা প্রতিফলিত হয়নি।
সংস্কার কমিশনগুলোতে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় হতাশা প্রকাশ করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন চাকমা সার্কেলের প্রধান রাজা দেবাশীষ রায়। ১৩ অক্টোবর তিনি তাঁর ফেসবুক পেজে দেওয়া পোস্টে লিখেছেন, ‘(সংস্কার কমিশনে) আদিবাসী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নারী এবং অন্যান্য প্রান্তিক বা সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা হয় সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত বা দৃশ্যমানভাবে অপর্যাপ্ত। এটা একজন নোবেলজয়ীর নেতৃত্বাধীন সরকারের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করেছে।’
রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, ‘সংস্কার কমিশন গঠনপ্রক্রিয়ায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা আমাকে ওই কমিশনে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এরপর কীভাবে সেই নিয়োগপ্রস্তাব বাতিল হয়ে গেল, সেটি আমি বলতে পারব না।’
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারে জোর দিচ্ছে। সংবিধান, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারে সুপারিশ দিতে পূর্ণাঙ্গ কমিশন গঠিত হয়েছে। পরে গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, নারী ও শ্রম বিষয়ে সংস্কারের সুপারিশের জন্য চারটি কমিশন গঠন ও প্রধানের নাম ঘোষণা করা হয়। এসব কমিশনের সদস্যদের নাম এখনো ঘোষণা করা হয়নি। ১৭ অক্টোবর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছিলেন, ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে কমিশনের সদস্যদের নাম ঘোষণা করা হবে।
কমিশনের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য সরকার কয়েকটি কমিটি ও টাস্কফোর্স গঠন করেছে। এসব কমিটিতে প্রতিনিধিত্বের ঘাটতি আছে।
সংস্কার কমিশনগুলো প্রতিনিধিত্বশীল না হওয়ার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা প্রথম আলোকে বলেন, কমিশনগুলো নাগরিক সমাজ, সংখ্যালঘু প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মতামত নিয়েই তাদের সুপারিশ বা প্রস্তাব তৈরি করবে। ফলে সমাজের সবার মতামতের প্রতিফলন ঘটবে বলেই সরকার মনে করছে।
চারটি কমিশনের প্রধানের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে অনানুষ্ঠানিক আলাপে তাঁরা স্বীকার করেন যে কমিশনগুলোতে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুসহ সব পক্ষের প্রতিনিধিত্ব নেই এবং নারী প্রতিনিধিত্বও কম।
অংশীজনদেরও আপত্তি
শুধু ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নয়, কমিশনে প্রতিনিধিত্ব না থাকা নিয়ে অংশীজনদের মধ্য থেকেও আপত্তি এসেছে। যেমন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন নিয়ে আপত্তি করেছেন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তাঁদের দাবি, এ কমিশন সব ক্যাডারের প্রতিনিধিত্ব করে না। এতে জনপ্রশাসনের সমস্যার সঠিক চিত্র উঠে আসবে না।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সাত সদস্যের মধ্যে ছয়জনই প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা। বাকি ২৫টি ক্যাডার সার্ভিসের মধ্যে কোনো ক্যাডারেরই সাবেক বা বর্তমান কোনো কর্মকর্তা এই কমিশনে নেই। এই কমিশনে আমলাদের বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম ফিরোজ আহমেদকে রাখা হয়েছে।
৫ অক্টোবর জনপ্রশাসন সংস্কারে গঠিত কমিশনের সদস্যদের প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেন প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ছয়টি কমিশনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সংবিধান সংস্কার কমিশন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলী রীয়াজের নেতৃত্বে গঠন করা এই কমিশনেও সংখ্যালঘু এবং বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই সংবিধান নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। কেউ কেউ বিদ্যমান সংবিধান বাদ দিয়ে নতুন করে সংবিধান লেখার পক্ষেও বলছেন। এই কমিশনে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব থাকা দরকার বলে মনে করেন অনেকে।
দেশের জনসংখ্যার ৯১ শতাংশের কিছু বেশি মুসলমান। ৯ শতাংশের মতো হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মের। জনসংখ্যার একটি অংশ জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু। প্রতিনিধিত্ব না থাকা নিয়ে তাদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।
বিষয়টিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন সাবেক বিচারপতি এম এ মতিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সংস্কার কমিশনগুলোতে নারী প্রতিনিধি কম এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু প্রতিনিধি না থাকা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এর পরও কমিশনগুলো সব পক্ষের স্বার্থ বিবেচনা করে সংস্কারের প্রস্তাব তৈরি করতে পারে। সে জন্য অপেক্ষা করা প্রয়োজন।
বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণে গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান। ১২ সদস্যের ওই টাস্কফোর্সে একজনও ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘু প্রতিনিধি নেই।
সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, সংস্কার কমিশন এবং কিছু কিছু কমিটি প্রতিনিধিত্বশীল হওয়া দরকার ছিল। এখনো সরকার সেগুলোকে প্রতিনিধিত্বশীল করতে নতুন সদস্য দিতে পারে। তিনি বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর আমরা বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের কথা বলছি। সব ক্ষেত্রেই বিষয়টি মনে রাখতে হবে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।
সূত্র : প্রথম আলো