মানুষের জীবনের জন্য বিশুদ্ধ অক্সিজেন যেমন অপরিহার্য, ঠিক তেমনি একটি নগরের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ রক্ষায় এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ, বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর ঢাকা বর্তমানে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের মারাত্মক ঘাটতিতে ভুগছে।
শহরের প্রতিটি কোণে গাছ কেটে ফেলা, খোলা স্থান ও উদ্যান ধ্বংস, এবং কংক্রিটের দালানে ঢেকে যাওয়া নগরজীবন ঢাকাবাসীর জন্য একটি বিশুদ্ধ নিঃশ্বাসও যেন এখন দুর্লভ হয়ে উঠেছে। ধুলাবালি ও বিষাক্ত ধোঁয়ার আধিক্যে জনস্বাস্থ্যে দেখা দিচ্ছে গুরুতর শারীরিক ও মানসিক সমস্যা।
ঢাকার ভৌগোলিক ও জনসংখ্যাগত চিত্র
প্রায় ৩০৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ঢাকা মহানগরে বসবাস করছে ১ কোটিরও বেশি মানুষ। শহরটি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে বিভক্ত, যেখানে রয়েছে মোট ১২৯টি ওয়ার্ড। কিন্তু এত বিশাল জনসংখ্যার জন্য নেই যথাযথ সবুজ পরিসর কিংবা প্রয়োজনীয় গাছপালা।
একসময় ঢাকাকে একটি ‘বাগানের শহর’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল। অথচ, বাস্তবে এখন উদ্যান, জলাশয় ও খেলার মাঠ হারিয়ে গেছে দখল ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের চাপে।
অক্সিজেনের ঘাটতি কতটা ভয়াবহ?
বন বিভাগ ও ইউএস ফরেস্ট সার্ভিসের জরিপ অনুযায়ী, ঢাকায় রয়েছে প্রায় ১৩ লাখ গাছ, যা জনসংখ্যার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল—প্রতি সাত জনের জন্য মাত্র একটি গাছ। দিনে এক কোটি মানুষের জন্য প্রয়োজন প্রায় ৫৫০ কোটি লিটার অক্সিজেন, অথচ বর্তমানে এই গাছগুলো যোগান দিতে পারে মাত্র ১৮ কোটি লিটার—যা প্রয়োজনের ৫ শতাংশও না।
দূষণের প্রধান কারণসমূহ
-
অপরিকল্পিত নগরায়ন ও নির্বিচারে গাছ কাটা
-
ফিটনেসবিহীন যানবাহনের ধোঁয়া
-
নির্মাণকাজের ধুলা ও রাস্তার আবর্জনা
-
ইটভাটা ও কলকারখানার বর্জ্য
-
দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও খোলা ডাস্টবিন
এই সবই বায়ুতে পিএম ২.৫ ও পিএম ১০-এর উপস্থিতি বাড়িয়ে তুলছে, যা ফুসফুসে ঢুকে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করছে।
স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিণতি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, দূষিত বাতাসের কারণে ঢাকায় প্রতি বছর মারা যাচ্ছে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। শিশুদের মধ্যে হাঁপানি ও নিউমোনিয়ার হার বেড়েছে, প্রাপ্তবয়স্করা আক্রান্ত হচ্ছেন উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, সিওপিডি, বিষণ্নতা ও স্লিপ ডিসঅর্ডারের মতো সমস্যায়। গর্ভবতী নারীরাও ঝুঁকির বাইরে নন—প্রি-ম্যাচিওর বার্থ ও কম ওজনের শিশুর জন্মের হার বাড়ছে।
উপায় ও করণীয়
বিশুদ্ধ অক্সিজেনের অভাব থেকে মুক্তি পেতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন—রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি পর্যায়ে।
নির্দেশনাসমূহ:
-
নগরের প্রতিটি খালি জায়গায় বৃক্ষরোপণ বাধ্যতামূলক করতে হবে
-
স্কুল, কলেজ ও কর্পোরেট পর্যায়ে গাছ লাগানোর সংস্কৃতি চালু করতে হবে
-
ছাদবাগান উৎসাহিত করতে করছাড় ও প্রণোদনা দিতে হবে
-
অবৈধ ইটভাটা ও কালো ধোঁয়ার গাড়ি নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে
-
পরিবেশবান্ধব যানবাহন ও প্রযুক্তি (যেমন স্মার্ট অক্সিজেন জেনারেটর) চালু করতে হবে
-
বায়ুদূষণ ও সবুজায়ন নিয়ে গণসচেতনতা বাড়াতে হবে
উপসংহার
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ শরীফ জামিল সঠিকভাবেই বলেছেন, বিশুদ্ধ অক্সিজেন গ্রহণ করা একটি মৌলিক অধিকার। এ শহরে যদি আমরা শুদ্ধ বাতাস না পাই, তবে সব উন্নয়নই একদিন আমাদের জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে। এখনই সময়, আমরা সবাই মিলে এই শহরকে “গাছবান্ধব নগর” হিসেবে গড়ে তুলি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যাই একটি বাসযোগ্য, সুস্থ নগর।












